"মননাৎ ত্রায়তে যস্মাৎ তস্মাৎ মন্ত্র উদাহৃতঃ।" যাহার মননের দ্বারা, চিন্তার দ্বারা, ধ্যানের দ্বারা সংসার-সাগর হইতে উর্ত্তীর্ণ হওয়া যায়, দুঃখ-কষ্টের হাত হইতে মুক্ত হইয়া পরমানন্দ প্রাপ্তি ঘটে তাহারই নাম মন্ত্র।
মন্ত্র বহু প্রকার; যদিও সকল মন্ত্রের উদ্দেশ্য এক। মন্ত্রের অর্থ ভাল করিয়া বুঝিলে আমরা দেখিতে পাইব যে, তাহার মধ্যে, বিশেষতঃ তাহার বীজের মধ্যে আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও তৎপ্রাপ্তির উপায় নিহিত আছে। সাধারণতঃ মন্ত্রের মধ্যে তিনটি অংশ থাকে,-প্রণব, বীজ ও দেবতা। একাক্ষর মন্ত্রগুলির মধ্যেও তিন তত্ত্ব নিহিত। প্রণব সর্ব্বব্যাপী ভগবৎ-তত্ত্ব প্রকাশ করে, বীজ ব্যষ্টি-জীবনের লক্ষ্য নির্দ্ধারিত করে, দেবতা সেই লক্ষ্যপ্রাপ্তির উপায় জানাইয়া দেয়। বটের বীজে যেমন একটা পূর্ণ পরিণত ফলে-ফুলে সশোভিত বৃক্ষে পরিণত হইবার শক্তি নিহিত, মন্ত্রের বীজের মধ্যেও সেইরূপ বিশিষ্ট জীবের পূর্ণ পরিণতি লাভের শক্তি নিহিত আছে।
ওঁকারের মধ্যে অতিসুন্দরভাবে সর্ব্বব্যাপী ভগবৎ-তত্ত্ব-পরমাত্মা-তত্ত্ব নিহিত। বীজের মধ্যে ব্যষ্টি-ভাবাপন্ন প্রত্যক্-চৈতন্যের সব তত্ত্ব নিহিত। দেবতাতত্ত্বের মধ্যে কিরুপে আমাদের ভিতরকার অন্তরেন্দ্রিয়, বহিরিন্দ্রিয় ও দেহাদির সব তত্ত্বের মধ্য দিয়া সেই প্রত্যক্-চৈতন্য পূর্ণভাবে পরিণতি লাভ করিতে পারে, সেই সব তত্ত্ব নিহিত আছে। ভগবৎ-চৈতন্য প্রকৃতির সব স্তরের মধ্য দিয়া কিভাবে প্রকাশ পায়, লীলা করে-তাহা লইয়া দেবতাতত্ত্ব। দেবতা সাক্ষাৎকার করার অর্থ-সেই সব তত্ত্বগুলির মধ্য দিয়া ব্যষ্টি-সমষ্টি ভাবে ভগবৎ-চৈতন্যকে অবাধিত ভাবে ফুটাইয়া বাহির করা-উপলব্ধি করা।
প্রণব হইতে বুঝা যাইবে আমার ভগবান কি তত্ত্ব, বীজ হইতে জানা যাইবে আমার স্বরূপ কি, আমার সঙ্গে ভগবানের কি সম্বন্ধ, ভগবানের কি বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ করিবার জন্য আমাকে সৃষ্টি করা হইয়াছে। দেবতার অর্থের মধ্যে দিয়া আমরা জানিতে পারিব কি উপায়ে আমার সে উদ্দেশ্য পূরণ হইতে পারে। প্রথমতঃ মন্ত্রের অর্থ বুঝিয়া লইতে হয়, তারপর মন্ত্রের সাধনার দ্বারা যখন মন্ত্র চেতন(জাগ্রত)হয়, তখন চিতর হইতে সেই তত্ত্বগুলির স্ফুরণ হয়; অর্থের ভিতর দিয়া যাহা বুঝিয়াছিলাম তাহা প্রত্যক্ষ হয়। "ওঁ ক্লীং কৃষ্ণায়" মন্ত্রে সাধকের সিদ্ধাবস্থায় "ওঁ" এর ভিতর দিয়া ভগবৎ তত্ত্বের(সমষ্টি ভাবের)উপলব্ধি হইবে, "ক্লীং" বীজের ভিতর দিয়া তাহার ভিতরে ঈষ্ট কৃষ্ণতত্ত্বের (ব্যষ্টিভাবের) স্ফুরণ হইবে এবং "কৃষ্ণায়" এই দেবতাতত্ত্বের ভিতর দিয়া তাহার জীবন কৃষ্ণময় হইয়া তাহার জীবনের ভাব ও কাজ কৃষ্ণ সদৃশ হইয়া পড়িবে। প্রত্যেক মন্ত্র সাধন-প্রণালীর একটা চুম্বক আকারের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। মন্ত্রের তিনটি অংশের মধ্যে প্রণবের সাহায্যে আমরা ভগবৎ-তত্ত্ব, বীজের সাহায্যে আমাদের ভিতরকার সুপ্ত ভগবৎ-শক্তি এবং দেবতাতত্ত্বের দ্বারা আমরা আমাদের পূর্ণ বিকাশের ভগবৎ-প্রাপ্তির সাধন-প্রণালী জানিতে পারি।
স্ত্রীলোকদিগের যে প্রণব বাদ দিয়া দীক্ষা দেওয়ার প্রণালী বাঙ্গালা দেশে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অবৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিবিরুদ্ধ। স্ত্রীলোকদিগিকে দাবাইয়া রাখিবার জন্য যাঁহারা এই যুক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন তাঁহারা ভুলিয়া যান যে, মৈত্রেয়ী গার্গী বাচক্লবী বৈদিক ঋষীগণও স্ত্রী-জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। স্ত্রী-দেবতা কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতিকে মাতৃজাতির পক্ষে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। মায়ের জাতকে এইভাবে অবমাননা করিয়া ভগবানের মাতৃভাব উপলব্ধি করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ওঁকারের ভিতরে আমরা 'অ'কার 'উ'কার ও 'ম'কার এবং অর্দ্ধমাত্রা এই তত্ত্বগুলি দেখিতে পাই। ভগবানের একাংশ ব্যক্ত(Emmanent)জগৎরূপে সৃষ্ট পরিণত বা বিবর্ত্তিত; অপরাংশ অব্যক্ত (transcendental)।ইহাই অর্দ্ধমাত্রা।
সুত্রঃ গ্রন্থ পূজা>শ্রীচুনীলাল সান্যাল।