বন্যা (Flood) তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোন নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়। তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত করলে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্লাবনভূমি যেহেতু মানুষের কাঙ্খিত ও কৃষিকাজের সহায়ক, তাই বন্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ও এর ক্ষয়ক্ষতি যাতে সীমা ছাড়িয়ে না যায় তা লক্ষ্য করা জরুরী।
প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখন্ড বন্যা কবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখন্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মৌসুমে ৮৪৪,০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বাৎসরিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। তুলনায় একই সময় দেশের অভ্যন্তরে ১৮৭,০০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদী প্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।
বাংলাদেশে বন্যার সংজ্ঞা স্বতন্ত্র। বর্ষাকালে যখন নদী, খাল, বিল, হাওর ও নিচু এলাকা ছাড়িয়ে সমস্ত জনপদ পানিতে ভেসে যায় এবং ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সহায়-সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে, তখন তাকে বন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বন্যার সঙ্গে ফসলের একটা সম্পর্ক রয়েছে
বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়: ক) মৌসুমি বন্যা (monsoon flood) - এই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে; খ) আকস্মিক বন্যা (flash flood) - আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয়; এবং গ) জোয়ারসৃষ্ট বন্যা (tidal flood): সংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বাৎসরিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গম পথ অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর পানির স্তরের এই উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। কারণ বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায় এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানির আভিকর্ষিক নিষ্ক্রমণ শুধুমাত্র বন্যার উপরে জেগে থাকা ভূমিতেই সীমাবদ্ধ। নিষ্ক্রমণ প্রতিবন্ধকতার কারণে সৃষ্ট বন্যা দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের উঁচুভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ডান দিকের প্লাবনভূমিগুলোকে রক্ষা করছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্লাবনভূমিসমূহকে ৩টি সুস্পষ্ট অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়, যথা: ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার বাম প্লাবনভূমি; মধুপুর গড় দ্বারা ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে বিচ্ছিন্ন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী উপত্যকা ও মেঘনা নদী অববাহিকা। মেঘনা অববাহিকা মহা-সিলেট-অবনমন (Great Sylhet Depression) দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত যেখানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী মিলিত হয়ে মেঘনা নাম পরিগ্রহ করেছে। মেঘনা নদীর পানির উচ্চমাত্রা বন্যার মৌসুমে ভাটিতে পদ্মানদীর পানির মাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্ষাকালের প্রারম্ভেই মেঘনা নদী দ্রুত বন্যার পানিতে ভরে ওঠে এবং বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা পূর্ণাবস্থাতেই বিরাজ করে। এই অববাহিকায় নিষ্ক্রমণের হার কম।